Friday, 26 December 2014

মালাক্কা থেকে শুরু


সিঙ্গাপুর থেকে ২০০ কিলোমিটার মতো দূরত্ব, মালাক্কার। মালয়েশিয়া এর একদম দক্ষিণ এ। এই ঘুরে এলাম মালাক্কা থেকে। তবে এই লেখা ভ্রমন কাহিনী নয়। মালাক্কা, সাউথ ইন্ডিয়া, গোয়া , পর্তুগিজ সব কি করে একই সাথে জড়িত এই লেখা সেটা নিয়েই।

আমরা যে বিশ্বায়ন এর কথা বলি সেটা কিন্তু শুরু হয়েছিল মধ্যযুগ থেকেই। ১৫১১ সালে মালাক্কা দখল নিলো পর্তুগিজরা। আজকের মালাক্কা এর দেখবার অনেক কিছুর মধ্যেই পর্তুগিজ ইতিহাস। চার্চ, ফোর্ট সব মিলিয়ে মালাক্কা যেন একটা গোয়া। সেটা ঠিক এমনি এমনি নয়। ১৫০৩ সালে ভাস্কো দা গামা গোয়া তে দ্বিতীয় বার আক্রমন করে। মোটে ৮ বছরের ভিতর পর্তুগিজ রা চলে এলো মালাক্কা তে। এই রকমই কোনো জাহাজ এ করে সেদিন পর্তুগিজ রা মালাক্কা আক্রমন করেছিল।




ওপরের জাহাজ এর মডেল Flor do Mar, এই মডেল টা মালাক্কা মেরীটাইম জাদুঘর এর। মালাক্কা দখল এর কিছু দিন পরেই ডুবে গেল এই জাহাজ। এর ইতিহাস ও বলবার মতো। কেন লিসবন এ এই জাহাজ তৈরী হতো , কেন ভারতেই, কেন বেজিং এ নয়। এই সব ছোট ছোট কাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে পশ্চিম এর কাছে পূর্ব এর হেরে যাবার আসল ইতিহাস। মালাক্কা সুলতান কে পরাজিত পর্তুগিজ দের সেইদিন বেশি সময় লাগে নি। গোয়া তে কিন্তু এর থেকে বেশি সময় লেগেছিল । মালাক্কা সেই দিন ছিল মালাক্কা সুলতানদের হাতে। মালাক্কা সুলতানদের ইতিহাস থেকেই শুরু এই কাহিনীর।


তবে সব শুরু এরও একটা শুরু থাকে। মালাক্কা এর ইতিহাস কে ৪ টে  ভাগ এ বলা যায় :

  1. পর্তুগিজ দের আসার আগের ইতিহাস  
  2. পর্তুগিজ - ডাচ দের ইতিহাস 
  3. ব্রিটিশ দের শাসনের ইতিহাস 
  4. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এর পরের থেকে আজকের মালাক্কা

একটা লেখা তে শেষ করা যাবে না। তাই এর প্রথম টা নিয়েই এই লেখা টা। পর্তুগিজ দের আসার আগের ইতিহাস
আসলে মালাক্কার মালাক্কা হয়ে ওঠার ইতিহাস।  যখন পর্তুগিজ রা মালাক্কা দখল করলো তখন মালাক্কা চালাছিল্লেন মালাক্কা সুলতানরা।  নামে সুলতান হলেও এরা কিন্তু আমাদের মোগলদের মত অন্য কোনো দেশ থেকে ছুটে আসা লোক না।  সুলতানরাই মালাক্কা, যা আগে ছিল একটা গ্রাম মাত্র (গ্রাম বলাও বেশি বলা হলো) সেই মালাক্কা কে একটা সমৃধ্হ অঞ্চল করেছিলেন - তাও মাত্র ১০০ বছরের ভিতর।

মালাক্কা সুলতান দের ইতিহাস দিয়েই বলা যাক গল্পটা। এই মালাক্কা সুলতানদের আদি পুরুষ ছিলেন পরমেশ্বর। সেই দিনের মালাক্কা ছিল জলদস্যুদের একটা গ্রাম। পরমেশ্বর সেই নেহাত ই অচা মালাক্কা কে পাল্টে করলেন একটা সমৃধ্হ অঞ্চল। এমন মালাক্কা এর প্রতিপত্তি হলো যে ১০০ বছরের মধ্যে দূর ইউরোপ থেকে পর্তুগিজ রা দখল করার জন্য ছুটে এলো।

পরমেশ্বর কিন্তু  প্রথমে ছিলেন আজকের সিঙ্গাপুর এর রাজা। ১৩৯০ এর কাছাকাছি পরমেশ্বর সিঙ্গাপুর এর রাজা ছিলেন। সেই সিঙ্গাপুর থেকে পালিয়ে তিনি মালাক্কা এলেন। সিঙ্গাপুর ছিল রাজার দুর্গ।  আজকের সিঙ্গাপুর এ রাজা পরমেশ্বর এর সেই যুগের দুর্গের কোনো চিহ্ন নেই।  লোক কথা বলছে রাজার ছোট্ট সিঙ্গাপুর ঘিরে ছিল এক উন্নত দুর্গ।

আক্রমণকারীরা দুর্গ সোজা পথে দখল করতে না পেরে খাবার এর সাপ্লাই লাইন বন্ধ করে দিল। সমুদ্র পথে আসত সেই দিন সব ফুড সাপ্লাই। তাই যেই খাবার বন্ধ হয়ে গেল দুর্গ এর পতন সময় এর অপেক্ষা। রাজা পিছন দিক পালালেন মালয়েশিয়া এর দিকে।  পথে পরলো একটা গ্রাম্, সেদিনের মালাক্কা। রাজা ঠিক করলেন এখানেই বসাবেন নতুন রাজ্য​. চার পাশের লোক কে পালিয়ে আসা রাজা সত্যই একটা নতুন সভত্যা শুরু করেছিলেন।

তা রাজা পরমেশ্বর সিঙ্গাপুর থেকে পালালেন কেন, আর কার তারা খেযেই পালালেন ?  মাজাপাহীট দের তাড়া খেয়ে সিঙ্গাপুর থেকে পালিয়ে যেতে হয়, রাজা কে। মাজাপাহীট  দের তখন্ রাজ্যপাট পুরো ইন্দোনেশিয়া জুড়ে। সত্যি বলতে গেলে আজকের ইন্দোনেশিয়া হয়ত হতই না মাজাপাহীট রা এই সাম্রাজ্য গঠণ না করলে।
সেই মাজাপাহীট রাই ২০০ বছর পরে মালাক্কা এর এই সুলতানদের প্রভাব প্রতিপত্তি এর ছায়া তে চাপা পরে যায়।

তা এই মাজাপাহীট  রা কারা আর রাজা পরমেশ্বর  ই বা কোথা থেকে এসেছিলেন।  সেই টাই পরের গল্প। আর সেটা আলোচনা করার সময় একটু জানতে হবে ইতিহাসের লেখার কঠিন জায়গা গুলো, মালাক্কা এর ভৌগলিক গুরুত্ব, ধর্মের ইতিহাস। আর সব কিছুর শেষ এ যাব ইন্দোনেশিয়া  তে।

আমাদের রাজা পরমেশ্বর এর পুরো নাম ছিল রাজা পরমেশ্বর ইস্কান্দার। সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের এর থেকে আর ভালো নাম কি হতে পারে ! ইস্কান্দার নাম টা কেন নিয়েছিলেন বলা মুশকিল। মালাক্কা এর জাদুঘর দাবি করে মুসলিম হবার পরে রাজার ভাগ্য ফিরে আসে। সত্যিই তো। যদি ধরে নি রাজা মালাক্কা এসে ইস্কান্দার নাম নিয়েছিলেন তাহলে তো বটেই।

মাজাপাহীট ইতিহাস বলতে গেলেই বলতেই হবে হিন্দু সভ্যতার একটা নিদারুণ দুর্বলতার কথা। লিখিত ইতিহাসের অভাব। এই লেখা জিনিস টা হিন্দু দের একে বারেই ছিল না। আজকেও নেই। অফিস এ কাউকে কিছু লিখতে বললেই লোককের মুখ ভার হয়ে যায়। বেদ, উপনিসদ থেকে প্রায় সব কিছুই স্মৃতি। লেখা র ব্যাপক প্রচার শুরু হলো ইসলাম থেকে। চীন এর লেখা র চল ছিল। এমনকি প্রথম ১০০০ বছরের ইতিহাস এর মূল উপাদান এসেছে হিউএন সেং আর সেই রকম চীনা পর্যটনকারী দের লেখা। তাই মধ্যযুগ এ যখন সবাই প্রিন্টিং শিখে গেল, ভারত এর হিন্দু সভত্যা এক ধাক্কা তে জ্ঞান বিজ্ঞান এ বিশাল পিছনেচলে গেল। তবে এই বার whatsapp , ফেসবুক এর যুগ এ বোধ হয় হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটবে, অন্য দের লেখার চল টা চলে যাবে। এই ভূমিকার দরকার এই টা বোঝানোর জন্য যে মাজাপাহীট দের লিখিত ইতিহাস এর খুব-ই অভাব। ঠিক তেমন ই অভাব ছিল রাজা পরমেশ্বর এর ইতিহাস এর। ১৬০০ এ মালাক্কা যখন পুরোটাই ইসলাম এর , তখন ই লেখা হলো ঠিক মত মালয় ইতিহাস। মাজাপাহীট দের আজকের কিছুটা চিহ্ন দেখা যায় বালি তে , বালি আজকেও হিন্দু। ঠিক ভারতের মত হিন্দু না , কিছুটা অন্য রকম হিন্দু। সেখানে রামায়ন রয়েছে, রাম রয়েছে, কিছু টা ভারত রয়েছে - অল্প কথা তে বলতে গেলে ভারত থেকে একদন যেন মহাভারত বা রামায়ন এর যুগে এই দ্বীপ চলে এসেছিল। হয়তো সত্যি টা কোনদিন জানা যাবে না। তবে এটা একটা হিন্দু সাম্রাজ্য বিস্তার এর গল্প না হতেও পারে। হয়তো হিন্দু দের দেখে অনুপ্রানিত হয়ে সাধারণ লোক হিন্দু ধর্ম নিয়েছিল। আজও ইন্দোনেশিয়া এর দ্বীপ দ্বীপ এ দেখতে পাবো আদিবাসীদের, যাদের ধর্ম হিন্দু না, বৌদ্ধ না।

মালাক্কা, সিঙ্গাপুর এর ভৌগলিক অবস্থান এর একটা অসাধারণ গুরুত্ব আছে। বিশাল এশিয়া এর ল্যান্ড মাস শেষ হয়ে আসছে সিঙ্গাপুর এর উপরে। তার পরে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত আছে শুধু অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ। দ্বীপ এর মাঝে মাঝে সমুদ্র পথ , ভীষণ স্রোত , সেই যুগ এর জাহাজ কেন, আজকের জাহাজ এর পক্ষেও খুব বিপদজনক। তাই স্ট্রেইটস অফ মালাক্কা আর স্ট্রেইটস অফ সিঙ্গাপুর মিলে সুরু সমুদ্র পথ সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়া এর ভিতর সেটা খুব-ই গুরুত্ব রাখতো (আজও রাখে , আজও পৃথিবীর প্রধান শিপিং লাইন এর ভিতরে এই স্ট্রেইটস লাইনস ) সেই জন্যই ১৫১১ সালে পর্তুগিজ, তার পরে ডাচ আর তার পরে ইংরাজ রা ফিরে ফিরে আসে এই মালাক্কা তে । পর্তুগিজ দের বাংলাদেশ এ আসার সময় ধরা যাক ১৫৬০। মালাক্কা দখল এর ৫০ বছর পরে । বান্ডেল চার্চ ১৬০০ সালের, সময় এর সমাপতন, সেই সময় ই মালাক্কা পর্তুগিজ দের থেকে ডাচ দের হাতে চলে গেল।

সেই দিনের ইন্দোনেশিয়া এর জায়গাতে শ্রী বিজয়া সাম্রাজ্য। নাম টা শুনলেই কেমন মনে হই ভারতীয়। দক্ষিণ ভারতের চোলা রাজারা গিয়ে দখল করেছিল কিছু টা আজকের ইন্দোনেশিয়া। শুধু ইন্দোনেশিয়া নয় আরো বিসর্তীর্ণ অঞ্চল এ চোলা সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল। আজকের লংকাওই , মালয়েশিয়া এর একদম উত্তরে প্রায় থাইল্যান্ড এর সীমান্তে একটা খুব পরিচিত দ্বীপ, টুরিস্ট এর খুব চেনা জায়গা। চোলা রা সেই লংকাওই দখল করে নিয়েছিল। চোলা দের দক্ষিণ এশিয়া এর এই সাম্রাজ্য এর নাম শ্রী বিজয়া। আমাদের স্কুল বই গুলোর ইতিহাস শুধু মোঘল দের ইতিহাস।
তাই আমরা জানতেই পারি নি তামিল দের এই অসাধারণ ইতিহাস। বেজাং ভ্যালি হলো উত্তর মালয়েশিয়া এর একটা অঞ্চল। আজকের মালয়েশিয়া এর সব থেকে বড় আর্কিওলজিকাল সাইট। প্রায় ২০০০ বছরের পুরনো অনেক মন্দির জানান দিচ্ছে হিন্দু এবং বৌদ্ধ প্রভাব। কোনো ভাবে সেই সময় হিন্দু ধর্ম চলে এসেছিল এই অঞ্চলে।

হিন্দু দের গর্ব করার আগে এটাও মনে রাখতে হবে তখন এই অঞ্চলে যা ধর্ম ছিল সবই ভারত থেকে শুরু --হিন্দু, বৌদ্ধ। ধর্ম এর প্রতিযোগিতা শুরু হলো প্রথম যখন ইসলাম এলো আর তার পরে ইউরোপিয়ান রা এলো। কি করে এই হিন্দু রাজ্য গুলো মুসলিম হয়ে গেল সেটা নিয়ে এর পরের ব্লগ এ আলোচনা করব। সেটাও এই ইতিহাস এর একটা অবিছিন্ন অংশ। শুধু এই টুকু বলে রাখি ইন্দোনেশিয়া প্রায় পুরো ইসলাম, মালয়েশিয়া ইসলাম কিন্তু তার পরের এশিয়া এর বাকি মাপ টা দেখেন যদি দেখবেন আইল্যান্ড ইসলাম এর চিহ্ন রয়েছে কিন্তু, ইসলাম প্রধান ধর্ম না। ম্যাপ এ দেখলে মনে হবে থাইল্যান্ড যেন ইসলাম এর প্রসারের বাফার জোন। এই অঞ্চলে ইসলাম এ প্রসার এর আসার ঠিক আগের মুহূর্তের গল্প এটা। 

No comments:

Post a Comment