সময়টা ধরা যাক ৭০০ খিস্টাব্দের কাছাকাছি। সেই সময় থেকে পরের ৮০০ বছরের ভিতর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এর পরিবর্তনের ইতিহাস টাই এই গল্প। ইতিহাস বলতে গেলেই বলতেই হবে হিন্দু সভ্যতার একটা নিদারুণ দুর্বলতার কথা। লিখিত ইতিহাসের অভাব। এই লেখা জিনিস টা হিন্দু দের একে বারেই ছিল না। বেদ, উপনিসদ থেকে প্রায় সব কিছুই স্মৃতি। লেখা র ব্যাপক প্রচার শুরু হলো ইসলাম থেকে। চীন এর লেখা র চল ছিল। এমনকি প্রথম ১০০০ বছরের ইতিহাস এর মূল উপাদান এসেছে হিউএন সেং আর সেই রকম চীনা পর্যটনকারী দের লেখা।
এই সময় এর উপাদান তাই বেশ কম। এই ব্লগ টা প্রথমে লিখবো ভেবেছিলাম ৭০০ খিস্টাব্দের থেকে ১৪০০ খিস্টাব্দ পর্যন্ত। পরে মনে হলো কেন, শুধু শ্রী বিজয়া নিয়েই তো কিছু কথা লেখা যায়।
এই কথা বলতে বলতে শ্রী বিজয়া এর কথা চলেই এলো। আজকের ইন্দোনেশিয়া এর জায়গাতেই ছিল শ্রী বিজয়া সাম্রাজ্য। বাঙালি পাঠক কে একটু ভূগোল মনে করিয়ে দিতে হবে - বালি বেড়াবার কথা অনেকই ভাবেন। বালি ইন্দোনেশিয়া এর বড় দ্বীপ। প্রায় বেশ কিছু হাজার দ্বীপ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া আজকের সব থেকে বড় মুসলিম দেশ। ইন্দোনেশিয়া কে সহজে বোঝানোর জন্য বলি ৩ তে ভাগ - সুমাত্রা, জাভা, বালি। প্রায় ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া তে ভারতের ছাপ সর্বত্র। ভারতের লোক এসে ইন্দোনেশিয়া দখল করেছিল এই ধারণা অনেকেরই। সেটা ঠিক না। প্রায় ৫০০০০ বছর ধরে মানুষ বসবাস করছে এই ইন্দোনেশিয়া ত়ে। অতি প্রাচীন এক সভত্যা। সমুদ্র পথে ভারত থেকে লোককের চলা চল ছিল, বাবস্যা বানির্জ্য ছিল। সেই থেকে ভারতের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। শ্রী বিজয়া নাম টা কি করে চালু হলো সেটা বলতে পারছি না । শ্রী বিজয়া হয়তো কোনো একটা রাজ্য ছিলো না। অনেক তা আজকের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর মতো এক ধরনের নিয়ম এ চলা অনেক গুলো রাজ্য নিয়ে শ্রী বিজয়া।
এই সাউথ ইস্ট এশিয়া যেন একটা ফার্স্ট ব্রাকেট এর ভিতর - একদিকে ভারত, অন্য দিকে চীন। সেই দিনের মানচিত্র টা একটু কল্পনা করা যাক । মালেশিয়া তে গভীর জঙ্গল, হিমালয় শেষ হয়ে যাচ্ছে ভারতের পূর্ব সীমান্তে, চীন থেকে নেমে আসছে উপত্যকা কম্বডিয়া এর উপরে। চীন প্রথমে এই দিকে ব্যাবসা করত না। চীন ট্রেড লাইন ছিল ইউরোপ এর দিকে আর ভারত এর দিকে। কিন্তু ধীরে ধীরে ইউরোপ ট্রেড মুশকিল হয়ে যায়। মাটির উপরে তখন অনেক বিপদ, চোর ডাকাত এর ভয়। আরো কত কি !! তাই সুমুদ্র পথে শুরু হলো চীনা জাহাজ যাত্রা। ভারতের জাহাজ চির কাল ই দক্ষিণ পূর্ব দেশগুলো তে যেত। চীনা আর ভারতের সমুদ্র লড়াই এর কোনো ইতিহাস নেই। .. তখন ভারতের জাহাজ আন্দামান সুমুদ্র দিয়ে আস্ত ইন্দোনেশিয়া এর পশিম দিক পর্যন্ত, সুমাত্রা পর্যন্ত। তার পরে মাল স্থল পথে যেত। আজকের মালাক্কা, সিঙ্গাপুর স্ট্রেইটস এর ভিতর দিয়ে ভারতের জাহাজ যেত কিনা বলা মুশকিল। বোধ হয় যেত না - জলদসুর ভয়। এ ছাড়া ডিসেম্বর এর বৃষ্টির জন্য জাহাজ কে দাড়িয়ে থাকতে হত। তাই আস্তে আস্তে পুরো ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়া এর পূর্ব আর পশিম দিকে অনেক বন্দর গড়ে উঠলো। পূর্ব দিকের বেশির ভাগ বন্দর এ আসত চীন এর জাহাজ। পশিম দিকের বন্দরের জাহাজ আস্ত ভারত থেকে। কিছু জাহাজ ছিল পূর্ব ভারতের - বাঙলা দেশ এর জাহাজ ও আসত। জাহাজ এলেই সাথে সাথে বেরিয়ে যেতে পারত না। হাওয়ার জন্যও জাহাজ অপেখ্যা করতো , কখনও কখনও মাসের পর মাস। নাবিক দের চরিত্র এর সুনাম কোনো কালেই ছিল না। সেই দিনেও তাই ইন্দোনেশিয়া এর দিকে দিকে ভারতীয়, চীনা নানা ধরনের লোকের মিসাল ঘটতে থাকলো।
সব সময়ই সাধারণ মানুষের ইতিহাস সব থেকে বেশি আকর্সনীয়। শ্রী বিজয়া দের কিছু কিছু প্রভাব থাইল্যান্ড এর দক্ষিণ এ দেখতে পাবো। মন্দির, শিল্পকলা সব কিছুর ভিতরে কিছু কিছু শ্রী বিজয়া প্রভাব কিছু কিছু রয়ে গেল। আজকের মালয় রা ই হয়ত সেই সময়ের শ্রী বিজয়া।
মুসি দক্ষিণ সুমাত্রার একটা বড় নদী। সেই মুসি নদীর ধারে ছিল শ্রী বিজয়া রাজধানী।
এই অনেক অনেক বন্দর ঘিরেই গড়ে উঠলো অনেক অনেক ছোট ছোট রাজ্য। শ্রী বিজয়া সাম্রাজ্য সম্পর্কে খুই কম জানা গেছে। ধরে নেবো যে এই সব ছোট ছোট রাজ্য নিয়েই তৈরী শ্রী বিজয়া।
শ্রী বিজয়া তো কিছুটা জানা গেল - এক গুচ্ছ ছোট মাঝারি বন্দর জনপদ নিয়ে তৈরী হওয়া এক সাম্রাজ্য। কিন্তু শৈলেন্দ্র রা? ভারতীয় দের এই শৈলেন্দ্র নিয়ে বেশ আগ্রহ আছে। নাম তো একেবারেই ভারতীয়।
৭০০ খিস্টাব্দের কাছাকাছি এলো শৈলেন্দ্র রা। কিছু ঐতিহাসিক বলেন কলিঙ্গ থেকে গিয়েছিলেন এই শৈলেন্দ্র রা। যাক.. . হয়ত এরা ইন্দোনেশিয়া এর লোকই ছিলেন। তবে সে যাই হোক - শৈলেন্দ্র রা খুবই ভারতীয় প্রভাবিত। আর কট্টর বৌদ্ধ। ওদের সময়ই তৈরী হলো বরবদুর এর সেই দারুণ মন্দির কমপ্লেক্স ।
এটা আবার একটা সমাপতন - ইলোরার বৌদ্ধ গুহা আর বরবদুর এর সময় প্রায় এক। ইলোরার বৌদ্ধ গুহা তৈরী শুরু হয়েছিল প্রায় ৫০০ সাল থেকে। হতেই পারে সেইলেন্দ্র রা সেই ইলোরার গুহা এর কথা শুনে বরোবদুর এর কথা ভাবলেন।
৭০০ খিস্টাব্দের কাছাকাছি - ভারতএ তখন বিশাল পাল সাম্রাজ্য, পশিম এ দিল্লি থেকে পূর্বে বাংলা পর্যন্ত পাল দের রাজ্যত্ব। রাষ্ট্রকুট দের বিশাল রাজ্যত্ব পশিমে। দক্ষিণ ভারতের দখল রয়েছে প্রধাণত ৩ দলের হাতে - চোলারা তামিল রাজ্যত্ব চালাচ্ছেন, পল্লব রা আজকের অন্দ্রপ্রদেশ দখল রেখেছেন, পান্দিয়াস এর দখলে ভারতের শেষ দক্ষিণ প্রান্ত। ধর্ম বলতে প্রধান দুটি - হিন্দু, বৌদ্ধধর্ম।জৈন ধর্ম ও ছিল, আজকের মতই কিন্তু রমরমা বলতে এই দুটির। তার ভিতর বৌদ্ধধর্ম ছিল প্রধাণ। ইলোরার বৌদ্ধ গুহা গুলো তৈরী হয়েছিল ৫০০ থেকে ৭০০ খিস্টাব্দের মধ্যে। কিন্তু কি ঘটল যে তার পরে আর ভারতে বড় বৌদ্ধ স্থাপত্যের এত অভাব ?
৮০০ খিস্টাব্দের শুরু র দিকের একটা সময়, ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র যে বড় পাল্টে গেল তা নয়। পাল্টে গেল ধর্মের মানচিত্র। আদি শংকর এর জন্ম আজকের কেরালা এর কাছাকাছি কথাও। শংকর জীবিত ছিলেন মোটে ৩২ বছর। কিন্তু তার ভিতর চিরকালের মতো ভারতবর্ষ পাল্টে দিলেন - একের পরে এক বৌদ্ধ পন্ডিত এর সাথে তর্কে জিতে হিন্দু ধর্ম কে ভারতে পুনরায় স্থাপন করলেন। শংকর এর নতুন হিন্দুত্ব্, হিন্দু এবং বৌদ্ধ এর মিলিয়ে তৈরী এক নতুন বাখ্যা। যাক, শংকর এর পরে বৌদ্ধ পন্ডিত রা খুঁজে বেড়াতে লাগলেন নতুন জায়গা। নজরে পড়ল ভারত এর পূর্ব প্রান্ত। আজকের বার্মা, কাম্বোডিয়া , থাইল্যান্ড। বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়ল এই দেশে।
শ্রী বিজয়া এর পুরো বিস্তার একটু দেখে নেবো। ছড়িয়ে পরেছিল অনেক অনেক দুরে। আজকের এই ম্যাপ এ যা জায়গা দেখছেন সবই আপনার পরের বছরের বেড়ানোর জায়গা হয়ে যেতে পারে। চাম্পা , খেমের, কম্বোডিয়া এর দারুন সব জায়গা। আনকোর ভাট এর অসাধারণ মন্দির এখানেই।

শ্রী বিজয়া কিন্তু ঠিক আজকে আমরা যে রকম মোঘল সাম্রাজ্য বুঝি তা ছিল না। এদের প্রধাণ আগ্রহ ছিল সমুদ্র পথে ব্যবস্যা করা। খুব জোর নদীর পর্যন্ত এদের আগ্রহ। তাই মুসি নদীর শুরু টাই দখল পরিবহণের কাজ এর দখল হাতে চলে এসেছিল। শ্রী বিজয়া সেই অর্থে প্রাচ্যের সুইজ ক্যানেল এর দখলে ছিলো। তাই টাকার অভাব কোনো দিনই ছিল না। একটু নিচের দিকে জাভা তে আর বালিতে ছিল অন্য দের দখল। শৈলেন্দ্র রা জাভা এর দখল নিয়ে ছিলেন।
বেশ তো শ্রী বিজয়া নিয়ে কথা হচ্ছিল শৈলেন্দ্র এসে কেমন যেন গুলিয়ে গেল না ? ম্যাপ দেখুন - জাভা এর ঠিক মাঝে কেদু। এই জায়গাটা দারুন রকমের সমতল। আগ্নেয়গিরি কিন্তু আগ্নেয়গিরির লাভা এ উপরে উর্বর চাষের জমি। শৈলেন্দ্র সভ্যতা ছিল প্রধানত চাষ নিয়ে। শ্রী বিজয়া এর জল নির্ভর অর্থনীতির পরিপূরক কিন্তু প্রতিযোগী না।
৯০০ খিস্টাব্দের কাছাকাছি এসে দেখলাম পল্লব রা ক্ষমতা থেকে চলে গেলেন, চোলা দের ক্ষমতা বাড়তে থাকলো। নাগাপত্তিনাম , চোল সাম্রাজ্য এর একটি বিখ্যাত সমুদ্র বন্দর , বর্তমানে তামিলনাড়ু, এর একটি জেলা। মধ্যযুগীয় সময়কাল থেকে এই বন্দর নগরী বাণিজ্যিকভাবে ও সাংস্কৃতিকভাবে , রাজনৈতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পর পর দুজন শক্তিশালী চোল রাজা এলেন, রাজরাজ চোল (985-1014 ) এবং পুত্র রাজেন্দ্র চোল (1012-1018 খ্রিষ্টাব্দ) ।
এই রাজেন্দ্র চোল এর সময় চোল রাজারা জয় করলেন, কেদাহ। আজকের লংকাওই। লংকাওই এর বিচ রিসোর্ট এর প্যাকেজ টুর চারিদিকে। কেদাহ এই জয় ওই সমুদ্র পথ টার দখল তুলে দিল চোল দের হাতে। আর একটা জিনিস ও ঘটল - ইন্দোনেশিয়া এর শ্রী বিজয়া সাম্রাজ্য আসতে আসতে দূর্বল হতে থাকলো । কেদাহ থেকে শ্রী বিজয়া এর দুরত্ব টা বড় কথা নয়। আসল গুরুত্ব জাহাজ এর ট্রেড লেন হাতের বাইরে চলে গেল।
শ্রী বিজয়া দের সাথে চোলা দের অনেক লড়াই হয়েছে। রাজেন্দ্র চোল এর কাছে হারাটা শ্রী বিজয়ন দের একটা বড় ধাক্কা। আস্তে আস্তে অন্য রা ইন্দোনেশিয়া, বলা ভালো সুমাত্রা এর বন্দর গুলো দখল করতে থাকলো। এই অন্য দের একটা নাম আছে। এরাই মাজাপাহিট। ১৩০০ সাল নাগাদ মাজাপাহিট দের উত্থান। কুবলাই খান তখন জাভা এর কিছু জায়গা দখল করেছিলেন। মাজাপাহিট রাজা কুবলাই খান এর চীনা বাহিনী দের কচু কাটা করলেন বলা চলে। মাজাপাহিট রা হিন্দু - শৈলেন্দ্র দের থেকে এটা একটা বড় অমিল। মাজাপাহিট দের সময় টাই ইন্দোনেশিয়া এর প্রাচীন স্বর্ণ যুগ। আজকের ইন্দোনেশিয়া ফ্ল্যাগ এও মাজাপাহিট এর পতাকার প্রভাব রয়েছে।
গল্প টা আরো অনেক বড় বলা যায়। মাজাপাহিট রাজা, রানী দের অনেক গল্প বলা যেতেই পারতো। কিন্তু অল্প করে বলে এগিয়ে যাই। এই শ্রী বিজয়া রা ছড়িয়ে পড়তে লাগলেন। তেমন এক রাজা ছিলেন Sri Maharaja Sang Utama Parameswara Batara Sri Tribuwana. না , সখের লেখা তে আমি আর এটার বাংলা লিখতে পারলাম না। তিনি তুমাসিক (সিঙ্গাপুর এর পুরাতন নাম ) এ জনপদ তৈরী করেন। 1366 চীনা সম্রাট তাঁকে শাসক এর মর্যাদা দিলেন। কিছু টা তো ছিলোই মাজাপাহিট দের ঝামেলা করার জন্য। কিন্তু তার নাতি শ্রী মহারাজা পরমেশ্বারান কে পালাতে হলো সিঙ্গাপুর ছেড়ে। সেই হিসাবে আজকের মালয়েশিয়া হলো শ্রী বিজয়া এর উত্তরাধিকারী। কুদুকান বুকিত একটা পাথরের লিপির নাম। মালয় লেখার প্রথম নমুনা। সেটাও শ্রী বিজয়া এর মুসি নদীর ধারেই মিলেছে। আদি মালয় হলো পল্লব লিপি। আসলে এই শ্রী বিজয়া বা, অন্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এর জনপদে তখন অনেক ভারতীয় আসতেন শুধু এডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে। ধরুন আজকের ওয়ার্ক পার্মিট আর কি !!! তাই মালয়েশিয়া এর ভিতরে বেছে থাকলো শ্রী বিজয়া এর গৌরব। রাজা পরমেশ্বারান প্রথমে কিছু দিন প্রায় জলদসুর মতো চালালেও পরে তৈরী করলেন মালাক্কা। শ্রী বিজয়া এর সমুদ্র বন্দর তৈরী করার অভিজ্ঞতা কাজে দিল।
ইন্দোনেশিয়া তে পরে থাকলো মাজাপাহিট এর উত্তরাধিকার। তাই তো বলছিলাম মালাক্কা এর ইতিহাস জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে আরো ৭০০ বছর আগে।
মাজাপাহীট রা সাম্রাজ্য বিস্তারও করে জল পথে (এই সব লড়াই ছিল জলের লড়াই , সেই সময় মাঠের লড়াই অন্য মাত্রা নিয়েছিল চিনে, মোঙ্গলদের হাতে )।
উইকিপেডিয়া এর ছবি টা সুন্দর , সেটা দেখালে বোঝা যাবে কি করে এই মাজাপাহীট সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো

শেষ কথা - ইতিহাস না জানা যেন যেমন ঠিক না, ইতিহাস নতুন করে তৈরীও হয় । আজকের সাউথ ইস্ট এশিয়া সমৃধ্হির এক নতুন ইতিহাস তৈরী করছে।
এই সময় এর উপাদান তাই বেশ কম। এই ব্লগ টা প্রথমে লিখবো ভেবেছিলাম ৭০০ খিস্টাব্দের থেকে ১৪০০ খিস্টাব্দ পর্যন্ত। পরে মনে হলো কেন, শুধু শ্রী বিজয়া নিয়েই তো কিছু কথা লেখা যায়।
এই কথা বলতে বলতে শ্রী বিজয়া এর কথা চলেই এলো। আজকের ইন্দোনেশিয়া এর জায়গাতেই ছিল শ্রী বিজয়া সাম্রাজ্য। বাঙালি পাঠক কে একটু ভূগোল মনে করিয়ে দিতে হবে - বালি বেড়াবার কথা অনেকই ভাবেন। বালি ইন্দোনেশিয়া এর বড় দ্বীপ। প্রায় বেশ কিছু হাজার দ্বীপ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া আজকের সব থেকে বড় মুসলিম দেশ। ইন্দোনেশিয়া কে সহজে বোঝানোর জন্য বলি ৩ তে ভাগ - সুমাত্রা, জাভা, বালি। প্রায় ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া তে ভারতের ছাপ সর্বত্র। ভারতের লোক এসে ইন্দোনেশিয়া দখল করেছিল এই ধারণা অনেকেরই। সেটা ঠিক না। প্রায় ৫০০০০ বছর ধরে মানুষ বসবাস করছে এই ইন্দোনেশিয়া ত়ে। অতি প্রাচীন এক সভত্যা। সমুদ্র পথে ভারত থেকে লোককের চলা চল ছিল, বাবস্যা বানির্জ্য ছিল। সেই থেকে ভারতের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। শ্রী বিজয়া নাম টা কি করে চালু হলো সেটা বলতে পারছি না । শ্রী বিজয়া হয়তো কোনো একটা রাজ্য ছিলো না। অনেক তা আজকের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর মতো এক ধরনের নিয়ম এ চলা অনেক গুলো রাজ্য নিয়ে শ্রী বিজয়া।
এই সাউথ ইস্ট এশিয়া যেন একটা ফার্স্ট ব্রাকেট এর ভিতর - একদিকে ভারত, অন্য দিকে চীন। সেই দিনের মানচিত্র টা একটু কল্পনা করা যাক । মালেশিয়া তে গভীর জঙ্গল, হিমালয় শেষ হয়ে যাচ্ছে ভারতের পূর্ব সীমান্তে, চীন থেকে নেমে আসছে উপত্যকা কম্বডিয়া এর উপরে। চীন প্রথমে এই দিকে ব্যাবসা করত না। চীন ট্রেড লাইন ছিল ইউরোপ এর দিকে আর ভারত এর দিকে। কিন্তু ধীরে ধীরে ইউরোপ ট্রেড মুশকিল হয়ে যায়। মাটির উপরে তখন অনেক বিপদ, চোর ডাকাত এর ভয়। আরো কত কি !! তাই সুমুদ্র পথে শুরু হলো চীনা জাহাজ যাত্রা। ভারতের জাহাজ চির কাল ই দক্ষিণ পূর্ব দেশগুলো তে যেত। চীনা আর ভারতের সমুদ্র লড়াই এর কোনো ইতিহাস নেই। .. তখন ভারতের জাহাজ আন্দামান সুমুদ্র দিয়ে আস্ত ইন্দোনেশিয়া এর পশিম দিক পর্যন্ত, সুমাত্রা পর্যন্ত। তার পরে মাল স্থল পথে যেত। আজকের মালাক্কা, সিঙ্গাপুর স্ট্রেইটস এর ভিতর দিয়ে ভারতের জাহাজ যেত কিনা বলা মুশকিল। বোধ হয় যেত না - জলদসুর ভয়। এ ছাড়া ডিসেম্বর এর বৃষ্টির জন্য জাহাজ কে দাড়িয়ে থাকতে হত। তাই আস্তে আস্তে পুরো ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়া এর পূর্ব আর পশিম দিকে অনেক বন্দর গড়ে উঠলো। পূর্ব দিকের বেশির ভাগ বন্দর এ আসত চীন এর জাহাজ। পশিম দিকের বন্দরের জাহাজ আস্ত ভারত থেকে। কিছু জাহাজ ছিল পূর্ব ভারতের - বাঙলা দেশ এর জাহাজ ও আসত। জাহাজ এলেই সাথে সাথে বেরিয়ে যেতে পারত না। হাওয়ার জন্যও জাহাজ অপেখ্যা করতো , কখনও কখনও মাসের পর মাস। নাবিক দের চরিত্র এর সুনাম কোনো কালেই ছিল না। সেই দিনেও তাই ইন্দোনেশিয়া এর দিকে দিকে ভারতীয়, চীনা নানা ধরনের লোকের মিসাল ঘটতে থাকলো।
সব সময়ই সাধারণ মানুষের ইতিহাস সব থেকে বেশি আকর্সনীয়। শ্রী বিজয়া দের কিছু কিছু প্রভাব থাইল্যান্ড এর দক্ষিণ এ দেখতে পাবো। মন্দির, শিল্পকলা সব কিছুর ভিতরে কিছু কিছু শ্রী বিজয়া প্রভাব কিছু কিছু রয়ে গেল। আজকের মালয় রা ই হয়ত সেই সময়ের শ্রী বিজয়া।
মুসি দক্ষিণ সুমাত্রার একটা বড় নদী। সেই মুসি নদীর ধারে ছিল শ্রী বিজয়া রাজধানী।
এই অনেক অনেক বন্দর ঘিরেই গড়ে উঠলো অনেক অনেক ছোট ছোট রাজ্য। শ্রী বিজয়া সাম্রাজ্য সম্পর্কে খুই কম জানা গেছে। ধরে নেবো যে এই সব ছোট ছোট রাজ্য নিয়েই তৈরী শ্রী বিজয়া।
শ্রী বিজয়া তো কিছুটা জানা গেল - এক গুচ্ছ ছোট মাঝারি বন্দর জনপদ নিয়ে তৈরী হওয়া এক সাম্রাজ্য। কিন্তু শৈলেন্দ্র রা? ভারতীয় দের এই শৈলেন্দ্র নিয়ে বেশ আগ্রহ আছে। নাম তো একেবারেই ভারতীয়।
৭০০ খিস্টাব্দের কাছাকাছি এলো শৈলেন্দ্র রা। কিছু ঐতিহাসিক বলেন কলিঙ্গ থেকে গিয়েছিলেন এই শৈলেন্দ্র রা। যাক.. . হয়ত এরা ইন্দোনেশিয়া এর লোকই ছিলেন। তবে সে যাই হোক - শৈলেন্দ্র রা খুবই ভারতীয় প্রভাবিত। আর কট্টর বৌদ্ধ। ওদের সময়ই তৈরী হলো বরবদুর এর সেই দারুণ মন্দির কমপ্লেক্স ।
এটা আবার একটা সমাপতন - ইলোরার বৌদ্ধ গুহা আর বরবদুর এর সময় প্রায় এক। ইলোরার বৌদ্ধ গুহা তৈরী শুরু হয়েছিল প্রায় ৫০০ সাল থেকে। হতেই পারে সেইলেন্দ্র রা সেই ইলোরার গুহা এর কথা শুনে বরোবদুর এর কথা ভাবলেন।
৭০০ খিস্টাব্দের কাছাকাছি - ভারতএ তখন বিশাল পাল সাম্রাজ্য, পশিম এ দিল্লি থেকে পূর্বে বাংলা পর্যন্ত পাল দের রাজ্যত্ব। রাষ্ট্রকুট দের বিশাল রাজ্যত্ব পশিমে। দক্ষিণ ভারতের দখল রয়েছে প্রধাণত ৩ দলের হাতে - চোলারা তামিল রাজ্যত্ব চালাচ্ছেন, পল্লব রা আজকের অন্দ্রপ্রদেশ দখল রেখেছেন, পান্দিয়াস এর দখলে ভারতের শেষ দক্ষিণ প্রান্ত। ধর্ম বলতে প্রধান দুটি - হিন্দু, বৌদ্ধধর্ম।জৈন ধর্ম ও ছিল, আজকের মতই কিন্তু রমরমা বলতে এই দুটির। তার ভিতর বৌদ্ধধর্ম ছিল প্রধাণ। ইলোরার বৌদ্ধ গুহা গুলো তৈরী হয়েছিল ৫০০ থেকে ৭০০ খিস্টাব্দের মধ্যে। কিন্তু কি ঘটল যে তার পরে আর ভারতে বড় বৌদ্ধ স্থাপত্যের এত অভাব ?
৮০০ খিস্টাব্দের শুরু র দিকের একটা সময়, ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র যে বড় পাল্টে গেল তা নয়। পাল্টে গেল ধর্মের মানচিত্র। আদি শংকর এর জন্ম আজকের কেরালা এর কাছাকাছি কথাও। শংকর জীবিত ছিলেন মোটে ৩২ বছর। কিন্তু তার ভিতর চিরকালের মতো ভারতবর্ষ পাল্টে দিলেন - একের পরে এক বৌদ্ধ পন্ডিত এর সাথে তর্কে জিতে হিন্দু ধর্ম কে ভারতে পুনরায় স্থাপন করলেন। শংকর এর নতুন হিন্দুত্ব্, হিন্দু এবং বৌদ্ধ এর মিলিয়ে তৈরী এক নতুন বাখ্যা। যাক, শংকর এর পরে বৌদ্ধ পন্ডিত রা খুঁজে বেড়াতে লাগলেন নতুন জায়গা। নজরে পড়ল ভারত এর পূর্ব প্রান্ত। আজকের বার্মা, কাম্বোডিয়া , থাইল্যান্ড। বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়ল এই দেশে।
শ্রী বিজয়া এর পুরো বিস্তার একটু দেখে নেবো। ছড়িয়ে পরেছিল অনেক অনেক দুরে। আজকের এই ম্যাপ এ যা জায়গা দেখছেন সবই আপনার পরের বছরের বেড়ানোর জায়গা হয়ে যেতে পারে। চাম্পা , খেমের, কম্বোডিয়া এর দারুন সব জায়গা। আনকোর ভাট এর অসাধারণ মন্দির এখানেই।

শ্রী বিজয়া কিন্তু ঠিক আজকে আমরা যে রকম মোঘল সাম্রাজ্য বুঝি তা ছিল না। এদের প্রধাণ আগ্রহ ছিল সমুদ্র পথে ব্যবস্যা করা। খুব জোর নদীর পর্যন্ত এদের আগ্রহ। তাই মুসি নদীর শুরু টাই দখল পরিবহণের কাজ এর দখল হাতে চলে এসেছিল। শ্রী বিজয়া সেই অর্থে প্রাচ্যের সুইজ ক্যানেল এর দখলে ছিলো। তাই টাকার অভাব কোনো দিনই ছিল না। একটু নিচের দিকে জাভা তে আর বালিতে ছিল অন্য দের দখল। শৈলেন্দ্র রা জাভা এর দখল নিয়ে ছিলেন।
বেশ তো শ্রী বিজয়া নিয়ে কথা হচ্ছিল শৈলেন্দ্র এসে কেমন যেন গুলিয়ে গেল না ? ম্যাপ দেখুন - জাভা এর ঠিক মাঝে কেদু। এই জায়গাটা দারুন রকমের সমতল। আগ্নেয়গিরি কিন্তু আগ্নেয়গিরির লাভা এ উপরে উর্বর চাষের জমি। শৈলেন্দ্র সভ্যতা ছিল প্রধানত চাষ নিয়ে। শ্রী বিজয়া এর জল নির্ভর অর্থনীতির পরিপূরক কিন্তু প্রতিযোগী না।
৯০০ খিস্টাব্দের কাছাকাছি এসে দেখলাম পল্লব রা ক্ষমতা থেকে চলে গেলেন, চোলা দের ক্ষমতা বাড়তে থাকলো। নাগাপত্তিনাম , চোল সাম্রাজ্য এর একটি বিখ্যাত সমুদ্র বন্দর , বর্তমানে তামিলনাড়ু, এর একটি জেলা। মধ্যযুগীয় সময়কাল থেকে এই বন্দর নগরী বাণিজ্যিকভাবে ও সাংস্কৃতিকভাবে , রাজনৈতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পর পর দুজন শক্তিশালী চোল রাজা এলেন, রাজরাজ চোল (985-1014 ) এবং পুত্র রাজেন্দ্র চোল (1012-1018 খ্রিষ্টাব্দ) ।
এই রাজেন্দ্র চোল এর সময় চোল রাজারা জয় করলেন, কেদাহ। আজকের লংকাওই। লংকাওই এর বিচ রিসোর্ট এর প্যাকেজ টুর চারিদিকে। কেদাহ এই জয় ওই সমুদ্র পথ টার দখল তুলে দিল চোল দের হাতে। আর একটা জিনিস ও ঘটল - ইন্দোনেশিয়া এর শ্রী বিজয়া সাম্রাজ্য আসতে আসতে দূর্বল হতে থাকলো । কেদাহ থেকে শ্রী বিজয়া এর দুরত্ব টা বড় কথা নয়। আসল গুরুত্ব জাহাজ এর ট্রেড লেন হাতের বাইরে চলে গেল।
শ্রী বিজয়া দের সাথে চোলা দের অনেক লড়াই হয়েছে। রাজেন্দ্র চোল এর কাছে হারাটা শ্রী বিজয়ন দের একটা বড় ধাক্কা। আস্তে আস্তে অন্য রা ইন্দোনেশিয়া, বলা ভালো সুমাত্রা এর বন্দর গুলো দখল করতে থাকলো। এই অন্য দের একটা নাম আছে। এরাই মাজাপাহিট। ১৩০০ সাল নাগাদ মাজাপাহিট দের উত্থান। কুবলাই খান তখন জাভা এর কিছু জায়গা দখল করেছিলেন। মাজাপাহিট রাজা কুবলাই খান এর চীনা বাহিনী দের কচু কাটা করলেন বলা চলে। মাজাপাহিট রা হিন্দু - শৈলেন্দ্র দের থেকে এটা একটা বড় অমিল। মাজাপাহিট দের সময় টাই ইন্দোনেশিয়া এর প্রাচীন স্বর্ণ যুগ। আজকের ইন্দোনেশিয়া ফ্ল্যাগ এও মাজাপাহিট এর পতাকার প্রভাব রয়েছে।
গল্প টা আরো অনেক বড় বলা যায়। মাজাপাহিট রাজা, রানী দের অনেক গল্প বলা যেতেই পারতো। কিন্তু অল্প করে বলে এগিয়ে যাই। এই শ্রী বিজয়া রা ছড়িয়ে পড়তে লাগলেন। তেমন এক রাজা ছিলেন Sri Maharaja Sang Utama Parameswara Batara Sri Tribuwana. না , সখের লেখা তে আমি আর এটার বাংলা লিখতে পারলাম না। তিনি তুমাসিক (সিঙ্গাপুর এর পুরাতন নাম ) এ জনপদ তৈরী করেন। 1366 চীনা সম্রাট তাঁকে শাসক এর মর্যাদা দিলেন। কিছু টা তো ছিলোই মাজাপাহিট দের ঝামেলা করার জন্য। কিন্তু তার নাতি শ্রী মহারাজা পরমেশ্বারান কে পালাতে হলো সিঙ্গাপুর ছেড়ে। সেই হিসাবে আজকের মালয়েশিয়া হলো শ্রী বিজয়া এর উত্তরাধিকারী। কুদুকান বুকিত একটা পাথরের লিপির নাম। মালয় লেখার প্রথম নমুনা। সেটাও শ্রী বিজয়া এর মুসি নদীর ধারেই মিলেছে। আদি মালয় হলো পল্লব লিপি। আসলে এই শ্রী বিজয়া বা, অন্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এর জনপদে তখন অনেক ভারতীয় আসতেন শুধু এডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে। ধরুন আজকের ওয়ার্ক পার্মিট আর কি !!! তাই মালয়েশিয়া এর ভিতরে বেছে থাকলো শ্রী বিজয়া এর গৌরব। রাজা পরমেশ্বারান প্রথমে কিছু দিন প্রায় জলদসুর মতো চালালেও পরে তৈরী করলেন মালাক্কা। শ্রী বিজয়া এর সমুদ্র বন্দর তৈরী করার অভিজ্ঞতা কাজে দিল।
ইন্দোনেশিয়া তে পরে থাকলো মাজাপাহিট এর উত্তরাধিকার। তাই তো বলছিলাম মালাক্কা এর ইতিহাস জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে আরো ৭০০ বছর আগে।
মাজাপাহীট রা সাম্রাজ্য বিস্তারও করে জল পথে (এই সব লড়াই ছিল জলের লড়াই , সেই সময় মাঠের লড়াই অন্য মাত্রা নিয়েছিল চিনে, মোঙ্গলদের হাতে )।
উইকিপেডিয়া এর ছবি টা সুন্দর , সেটা দেখালে বোঝা যাবে কি করে এই মাজাপাহীট সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো

শেষ কথা - ইতিহাস না জানা যেন যেমন ঠিক না, ইতিহাস নতুন করে তৈরীও হয় । আজকের সাউথ ইস্ট এশিয়া সমৃধ্হির এক নতুন ইতিহাস তৈরী করছে।